Header Ads Widget

Responsive Advertisement

সাহেদের প্রতারণার আরেক হাতিয়ার জাল টাকা

 

 

 

 

 


জাল বা নকল জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নিয়েছিলেন অনেক নাম। অফিসে মিলেছে অনেক রকম জাল লাইসেন্স। তাঁর হাসপাতালের পরীক্ষার হাজারো জাল পরীক্ষার আলামত মিলেছে। জাল প্রমাণপত্র দিয়ে নিয়েছেন ব্যাংকঋণ। জাল ফরমায়েশ ও নথিপত্রে করেছেন ব্যাবসায়িক লেনদেন। জাল স্বাক্ষরে চেক দিয়ে প্রতারিত করেছেন পাওনাদারকে। এসব অপকর্মের হোতা মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের আরেকটি জালিয়াতির তথ্য মিলেছে। কারো সঙ্গে কোনো লেনদেন করতে গেলে সাহেদ ব্রিফকেস বা ব্যাগভর্তি টাকা সঙ্গে নিতেন। কম টাকার প্রয়োজনেও ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেখাতেন। এর মাধ্যমে সাহেদ নিজেকে টাকাওয়ালা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন। তবে ব্যাগে কিছু আসল নোট থাকলেও বেশির ভাগই থাকত জাল নোট।

গত বুধবার রাজধানীর উত্তরায় সাহেদের গোপন অফিস থেকে এক লাখ ৪৬ হাজার টাকার জাল নোট উদ্ধার করার পর এসংক্রান্ত কিছু তথ্য খতিয়ে দেখছে র‌্যাব। জাল নোট উদ্ধারের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ৬১টি মামলার তথ্য পাওয়া গেল।

র‌্যাব ও পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, জালিয়াতিতে সিদ্ধহস্ত সাহেদ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের রোগী পরীক্ষার যন্ত্র কেনার নামে টাকা হাতিয়েছেন। সামান্য কিছু যন্ত্র প্রদর্শন করা হলেও ব্যবহার করা হতো না। হাসপাতালে র‌্যাবের অভিযানের পর নিজের ফোন বন্ধ রেখে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় অন্য নম্বর ব্যবহার করে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে তদবির করেন তিনি। এসব তদবিরে কাজ না হলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে তাঁকে খুঁজছে সে তথ্য ঠিকই পেয়েছেন সাহেদ।

এদিকে গতকাল সাহেদ ও রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। সাহেদের সহযোগী তারেক শিবলীকে দ্বিতীয় দফায় সাত দিনের রিমান্ডের আদেশও দেন একই আদালত। কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে হাজির করার পর সাহেদ কাঁদতে কাঁদতে নিজে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে সাহেদ স্বীকার করেছেন, তিনি জাল টাকা দিয়ে মানুষকে প্রতারণা করতেন। তিনি জাল টাকা তৈরি করতেন না। জাল টাকার লেনদেন করতেন। পাওনাদারদেরও এই টাকা দিতেন।’

উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা বলেন, উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের ৬২ নম্বর বাড়িতে সাহেদের গোপন অফিস থেকে জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় র‌্যাব-১ কর্মকর্তা মজিবুর রহমান বাদী হয়ে সাহেদকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করেছেন। এ মামলায় এমডি মাসুদ পারভেজ ও অজ্ঞাতপরিচয় আরো কয়েকজনকেও আসামি করা হয়েছে।

বনানীর ডিওএইচএসের ৪ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতেন সাহেদ। ওই বাড়ির মালিকের বোন লিনিয়া দেওয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, দুই বছর আগে বাসা ভাড়া নিতে আসেন সাহেদ। তাঁর সঙ্গে অনেক অস্ত্রধারী দেহরক্ষী ছিল। এ অবস্থা দেখে তাঁকে বাসা ভাড়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাই তাঁর কাছে বেশি ভাড়া এবং তিন মাসের অগ্রিম ভাড়া চান লিনিয়া। সাহেদ তখন একজনকে হাতে ইশারা করেন। ইশারার পর একটি ব্রিফকেস বাসায় নিয়ে ঢোকেন ওই ব্যক্তি। ব্রিফকেস খুলেই তিন মাসের ভাড়ার টাকা অগ্রিম দেন সাহেদ। ওই ব্রিফকেসে আরো অনেক টাকা ছিল। লিনিয়া টাকাগুলোর সবই নকল ভাবলেও যাচাই করে তাঁকে দেওয়া টাকাগুলো আসলই পান।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, এসএসসি পাস সাহেদ জাতীয় পরিচয়পত্রে সাহেদ করিম নাম পরিবর্তন করে মো. সাহেদ হতে  নির্বাচন কমিশনে ‘ও’ লেভেলের সনদ জমা দিয়েছেন। ওই শিক্ষাগত সনদের সত্যতা খতিয়ে দেখা হবে।

আদালতেও নিজেকে জাহির করতে চান সাহেদ : গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাহেদ, মাসুদ ও তারেক শিবলীকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা। এ সময় সাহেদের কোমরে দড়ি বাঁধা ছিল, শরীরে ছিল বুলেট গ্রুফ জ্যাকেট। মাথায় হেলমেট এবং চোখে কালো চশমা ছিল। শুনানি শেষে আদালত সাহেদ ও মাসুদের ১০ দিন এবং তারেক শিবলীর দ্বিতীয়বারের মতো সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই মামলায় রিজেন্ট হাসপাতালের অন্য সাতজনকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। 

রিমান্ড শুনানির সময় কাঠগড়া থেকে সাহেদ বলেন, ‘স্যার, যখন কেউ করোনার চিকিৎসা দিতে এগিয়ে আসেনি তখন আমি, আমার হাসপাতাল এগিয়ে এসেছিল। সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছি। আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমার বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমার ব্যবস্থাপনা পরিচালক করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।’ তিনি লাইসেন্স নবায়নের জন্য সম্প্রতি ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার দাবিও করেন।

গতকাল মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আব্দুল বাতেন বলেন, রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হতো। জিজ্ঞাসাবাদে সাহেদ কিছু বিষয় স্বীকার করেছেন। তাঁকে রিমান্ডে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

একটি সূত্র জানায়, রিজেন্ট হাসপাতালের জন্য এমআরআই মেশিন কিনতে দুই কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নিয়ে একটি কিস্তিও পরিশোধ করেননি সাহেদ। ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংক থেকে এমআরআই মেশিন কিনতে ওই ঋণ নেন সাহেদ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি পদ্মা ব্যাংক নামে পরিচিত। ওই ঘটনায় মামলা হলেও জামিন নিয়ে নেন সাহেদ। 

পালিয়ে তদবির করেন সাহেদ : পুলিশ ও র‌্যাবের একাধিক সূত্র জানায়, গত ৬ ও ৭ জুলাই উত্তরা ও মিরপুরে রিজেন্ট হাসপাতালে র‌্যাবের অভিযানের সময় ঢাকায় অবস্থান করে প্রভাবশালী অনেকের কাছে তদবির করেন সাহেদ। তাঁদের অনেকে তাঁকে করোনায় ভয়ংকর জালিয়াতি করায় সহায়তা করা যাবে না বলে জানিয়ে দেন। নিজের ফোন বন্ধ করে ভিন্ন নম্বর থেকে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি জেনেছেন সাহেদ। এ কারণে র‌্যাবের অভিযানের সময় একাধিকবার সরে পড়তে সক্ষম হন তিনি।

গত বুধবার সাতক্ষীরায় গ্রেপ্তার করে সাহেদকে ঢাকায় আনার পর তিনি র‌্যাবের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বলেন, তাঁরা যেন গণমাধ্যমের সামনে তাঁকে হাজির না করেন। একপর্যায়ে ছয় মাসের মধ্যে বের হয়ে আসবেন বলে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আমার সঙ্গে আপনাদের আবারও দেখা হবে। আপনাদের প্রমোশন-পোস্টিং যা-ই হোক না কেন, আমি কিন্তু দেখা করব। কথাটা মনে রাখবেন।’

আমাদের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি দেবহাটা থানার ওসি বিপ্লব কুমার সাহার বরাত দিয়ে জানান, র‌্যাব-৬-এর উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে যে মামলা করেছেন, তাতে সাহেদ ও মাসুদ ছাড়াও বাচ্চু মাঝিকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের দুজনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।

Post a Comment

0 Comments